Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

Image
Title
আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি
Details

বধ্যভূমির স্মৃতি মানে বুকের ভেতর খুব করে হাহাকার তোলা বিভীষিকাময় দুরু দুরু কাঁপন। বধ্যভূমির নাম শুনলেই কানে বাজে নাম না জানা অসংখ্য মর্মান্তিকভাবে মৃত স্বজনের অস্তিত্বের সুতীব্র যন্ত্রনার আহাজারি। কুমারী বোনের বুকফাটা গগণবিদারি আর্তনাদ। সহস্র যন্ত্রণায় শহীদ শ শ মা-বোনের নীল কাতরানি। বর্বরতম এ হত্যাকান্ডের বেদনামথিত ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে এখানে। এখানে মুক্তির আনন্দকে ছাপিয়ে যায় কান্নার করুন রোল।
’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে ছুটে গিয়ে যিনি খোদ আলমডাঙ্গা থানায় উড্ডীন পাকিস্থানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে অমিত সাহসে অগ্নি সংযোগ করেছিলেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমডাঙ্গা কালিদাসপুরের মঈন উদ্দীন আহমেদের সাথে কথা হয়। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার সময় তিনি বধ্যভূমি সম্পর্কে বলেন, আলমডাঙ্গায় রেললাইনের কুমার নদের উপর অবস্থিত লালব্রীজের দুপাশে ছিল পাকিস্থানি মিলিশিয়া বাহিনির ক্যাম্প। রেললাইনের ডাউনে অর্থাৎ লালব্রীজের আলমডাঙ্গার পাশে ১টা ও নদের অপর পারে অর্থাৎ কালিদাসপুরে আরেকটা মিলিশিয়া ক্যাম্প ছিল। আপের দিকে গমণকারি ট্রেন লালব্রীজের আলমডাঙ্গা মাথায় দাঁড় করাত। অন্যদিকে, ডাউনগামি ট্রেন লালব্রীজের কালিদাসপুর প্রান্তে দাঁড় করিয়ে নিরাপরাধ যাত্রিদের ধরে ধরে নিয়ে যেত। অকথ্য নির্যাতন শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ এ বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখত। প্রথম দিকে, এ সকল মিলিশিয়া নরাধম খুঁজে খুঁজে ট্রেন থেকে হিন্দু ধর্ম্বালম্বীদের আটক করতো। তাদের সন্দেহভাজন ট্রেনযাত্রিকে কলেমা কিংবা কোরানের কোন সুরা জিজ্ঞেস করতো। বলতে না পারলেই অবধারিত বিভীষিকাময় নির্যাতন শেষে মৃত্যু। কাউকে কাউকে আবার বিবস্ত্র করে দেখত হিন্দু না মুসলমান। সিথিতে সিদুর দেখতে পেলে তো কোন কথা নেই। সরাসরি সে মহিলাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখতো বধ্যভূমির সামনে জিকে প্রকল্পের টার্সিয়ারি খালের পাশের ওয়াপদা করে। বেশ কয়েকদিন ধরে যথেচ্ছা ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করত। পরে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে তখন হিন্দু-মুসলমান উভয়ই সমানভাবে এ প্রাণঘাতি নির্মমতার শিকার হন।
কালিদাসপুরের বেশ কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে কথা হয়। তারা বলেন, আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি বরাবর কুমার নদের অপর পাড়ে কালিদাসপুর মাঠের মধ্যেও শ শ নারী-পুরুষকে ট্রেন থেকে নামিয়ে মিলিশিয়ারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। কালিদাসপুরের মৃত আজগর আলীর ছেলে আলফাজ আলীর (তিনিও প্রায় ১ বছর পূর্বে মারা গিয়েছেন)  সাথে এ সম্পর্কে কথা হয়। বয়স্ক এ কৃষক নিজেই স্বীকার করেন কী নির্মম ঘটনার তিনি কালসাক্ষী! তিনি মাটি খুঁড়ে এখানেই একই গর্তে ৩/৪ জনকে পুঁতে রখেছিলেন। তিনি একাই বহু নারী-পুরুষের লাশ মাটিতে পুতে রেখেছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি তখন সদ্য যুবক। বুকে ভাল করে লোম গজায়নি। তার ঈষৎ লোমশ বুকে পাক হানাদার রাইফেলের বেনোয়েট ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়ে বিনা পয়সায় এ নির্মম কাজ করিয়ে নিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ৪০ বছরে পার হলেও এখানে আত্মদানকারি শহীদ বীরাঙ্গনা কিংবা পুরুষদের কোন স্মারক নির্মিত হয়নি। এমন ভয়ার্ত স্মৃতির স্বাক্ষ্য স্বরূপ ছড়ানো ছিটানো স্মারকচিহ্নগুলি সময়ের ব্যবধানে এক সময় হারিয়ে যায়। কাল প্রবাহের স্বাভাবিক নিয়মে এ ভয়াল স্মৃতি প্রত্যক্ষদর্শি মানুষের মনেও ফিকে হয়ে আসে। নতুন প্রজন্ম কিংবা দূরান্তের ছিন্নমুল মানুষ যারা স্বাধীনতা পরবর্তিকালে এই এলাকায় পূনর্বসিত, তারা সম্পূর্ণরূপে এখন সে দুঃসহ বিষাদময় স্মৃতি বিস্মৃত হয়েছে।
গত ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠণ করলে শুরু হয় বধ্যভূমি নির্মাণের প্রাথমিক কাজ। সে সময় জিকে ক্যানেলের ঢালে বসবাসকারি ছিন্নমুল কয়েকজন মানুষ খুঁড়াখুঁড়ি করার সময় লাশের বহু হাড় মাটির নীচ থেকে বের হতে থাকে। বিষয়টি গোপন থাকে না। সকলে ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। বিষয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে মুক্তিযোদ্ধারা দাবি তোলেন এ জায়গাটা সংরক্ষণ করে বধ্যভূমি নির্মাণের। মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতি বিধান করে মাননীয় হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুন-এমপি আলমডাঙ্গার বধ্যভূমির স্মারক নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তার আর্থিক বরাদ্ধে সৌকর্যময় শৈল্পিক সুষমায় বধ্যভূমি নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলে। বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও নির্মাণের ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য অবদান রাখেন মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলী। পরবর্তিতে স্থানীয়ভাবে সর্বাধিক ভূমিকা রাখেন আওয়ামীলীগ নেতা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ি আওরঙ্গজেব মোল্লা টিপু। এরই মধ্যে দর্শনার্থিদের ভীড় পরিলক্ষিত হয় এখানে। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষ অব্যক্ত বেদনাতাড়িত হয়ে ছুটে আসেন এখানে। হৃদয়ের অসহ্য দহন জ্বালা, ঘৃণা-ক্রোধ, রিরংসা দূর করে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেতে এখানে আসেন অনেকে। অনেকে ছুটে যান বিনোদনের জন্যেও।
এখনো বধ্যভূমির স্মারক নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। এ বধ্যভূমির ডিজাইনার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক আলমডাঙ্গার সন্তান আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, “এখনো বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ বাকি রয়েছে। দেয়ালের উপরের কিছু কাজ, মিউজিয়ামের ভেতরের কিছু কিছু ফিগার, ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙ্গালির ধারাবাহিক মুক্তিসংগ্রামের সচিত্র ছবির আরও কিছু কাজ বাকি। এগুলো করতে অনেক টাকা খরচ হবে। এছাড়াও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ছবি, তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের কাজ, মুক্তিযুদ্ধের উন্মুক্ত ভাস্কর্য নির্মাণ করতে হবে। মুলত সমন্বয়হীনতার কারণে বাকী কাজ করা এখনও সম্ভব হয়নি।” চুয়াডাঙ্গা -১ আসনের সাংসদ মাননীয় হুইপ নিজেও বীর মুক্তিযোদ্ধা। সঙ্গত কারনেই আলমডাঙ্গা বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন ও একে আরও আকর্ষনীয় করার ক্ষেত্রে মাননীয় হুইপের উপর এলাকাবাসির আস্থা রয়েছে।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি মুক্তিযুদ্ধের পর সারাদেশে খুঁজে পাওয়া বধ্যভূমিগুলো (কিলিং ফিল্ড) যাতে নতুন প্রজন্মসহ সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপিত হতে পারে সে ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা গুগল সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এজন্য তৈরি হয়েছে গ্লোবাল পারসেপশন বা জিপিএস ম্যাপ। এলাকাবাসির দাবি- ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস কমিটির কার্যক্রমের অন্তর্গত করা হোক আলমডাঙ্গার বধ্যভূমিটি। এ ব্যাপারে আশু উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতনমহল।